বিভূতিভূষণ আস্বাদনপন্থী, বিশ্লেষণপন্থী নন। জীবনের ব্যাখ্যাতার ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেননি,তিনি জীবনের উপভোক্তা...........................................
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণীয় কেন ? বিভূতিভূষণের আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' আলোচনা কর?
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ আস্বাদনপন্থী, বিশ্লেষণপন্থী নন। জীবনের ব্যাখ্যাতার ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেননি,তিনি জীবনের উপভোক্তা। তারাশঙ্করের রুদ্রতা, মানিকের বিজ্ঞানবুদ্ধি বা প্রেমেন্দ্রের জীবনতৃষ্মা তাঁর মধ্যে নেই—কিন্তু এই তিনজনের মতোই জীবন এবং মানুষের প্রতি তাঁর অকৃপণ মমতা আছে। তাঁর সাহিত্যে একদিকে একটি সরল পল্লিপ্রাণ মানুষ – যে সামাজিক, হৃদয়বান, পরদুঃখকাতর, সংযত ইন্দ্ৰিয়, অন্যদিকে একটি ঘরভোলা মুগ্ধদৃষ্টি কিশোর—যার চোখের সামনে প্রকৃতি প্রতিদিন নবনব রহস্যের যবনিকা উম্মোচিত করেছে।
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মসন । বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠআত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনা 'পথের পাঁচালী'।১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে 'পথের পাঁচালী' প্রথম প্রকাশিত হয় 'বিচিত্রা' পত্রিকায়। 'পথের পাচালী'র উত্তরকাণ্ডের নাম ছিল 'অপরাজিত'।‘অপরাজিত''প্রবাসী' পত্রিকায়, (১৩৩৬-৩৮বঙ্গাব্দে) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ।
এ ছাড়া বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসগুলি হল-উত্তর 'পথের পাঁচালী (১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ), 'অপরাজিত' (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ), 'দৃষ্টিপ্রদীপ' (১৩৪২ বঙ্গাব্দ), 'আরণ্যক' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), 'দেবযান' (১৩৫১ বঙ্গাব্দ),‘ইচ্ছামতী' (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ) প্রভৃতি।বিভূতিভূষণের গল্পগ্রন্থ হল-মেঘমল্লার' (১৩৩৮), 'মৌরীফুল' (১৩৩৯), 'যাত্রা-বদল' (১৩৪১) প্রভৃতি।
বিভূতিভূষণের ছোটোগল্প মূলত তিনটি উপাদানে গঠিত সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি ও অতিপ্রাকৃত ,এই তিনের মিলনসেতু সহজসরল মানুষ ও লেখকের অধ্যাত্মচেতনা উভয়ের সঙ্গে যুক্ত। সেদিন থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবি দৃষ্টির উত্তরাধিকার বহন করেন। তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক, কিন্তু তাঁর ছোটোগল্পে মানুষেরই প্রাধান্য, প্রকৃতি পৃথক কোনো চরিত্র হয়ে ওঠেনি।
অপু, দুর্গা, সর্বভারা, হরিহর 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসের চরিত্র ।এবং সত্যচরণ, ফুপু সিং, ভানুমতী, দোবরুপান্না, কুত্তা—আরণ্যক'উপন্যাসের চরিত্র '।'ক্ষেপ্তি' বিভূতিভূষণের 'পুঁইমাচা' গল্পের চরিত্র । 'আরণ্যক' উপন্যাসে বিভূতিভূষণের প্রকৃতি মুখ্য, মানুষ গৌণ ।
বিভূতিভূষণের জনপ্রিয়তার কারণ :-
বিভূতিভূষণ বাংলাদেশের (এবং বাংলার বাইরের—'আরণ্যক') ভূপ্রকৃতির বুকে যে সমস্ত বালক, শিশু, যুবক বৃদ্ধের ছবি এঁকেছেন তার মূলরস হল রূপকথার রস। পরিচিত বিবর্ণ দেশকালের অন্তরে অপূর্ব কল্পলোকের রসবন্ধু লুকিয়ে আছে, কঠোর বাস্তবের মধ্যেই একটি রূপলোকের স্বপ্নমাধুরী নিহিত রয়েছে। শিশুর মতো কৌতূহল এবং কবির মতো কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণের অননুকরণীয় ভাষায় এমন গ্রামীণ জীবনের চিত্র এঁকেছেন যে, চিত্র হিসেবে তা অনবদ্য এবং অনতিক্রমনীয়।
'আরণ্যক' উপন্যাসের বিশিষ্টতা আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় বিশাল অরণ্যপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রহস্যময় যোগাযোগের নিবিড় অনুভূতি, বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক' উপন্যাসের উপজীব্য। সেই রহস্যময়তা অপূর্ব সৌন্দর্যলোক সৃষ্টি করেছে 'আরণ্যক'-এ।
'দেবযান' উপন্যাসের মূলভাবটি লেখো।
বিভূতিভূষণের রূপাতীত লোকের প্রতি পিপাসা 'দেবযান' উপন্যাসে অলৌকিক লোকে উপস্থিত হয়েছে। প্রতিদিনের জীবনের মধ্যে যে রোমান্সের রস এবং ইন্দ্রয়াতীত উপলব্ধির রহস্যময় ব্যঞ্জনা রয়েছে, বিভূতিভূষণ তার প্রতি তর্জনী তুলেছেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণীয় কেন ?
চিত্র, ঘটনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাত্ত্বিক সংঘাত, সামাজিক প্রশ্ন, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে এসবের বিশেষ বাহুল্য নেই। আছে চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনধারণের মধ্যে, অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত, রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সে দিক থেকে শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনো কোনো সমালোচক উপন্যাসকার না বলে পাঁচালিকার বলেছেন একথার যৌক্তিকতা কী ?
কোনো কোনো সমালোচকের মতে, অন্তর্দ্বন্দ্বমুখর ও মনস্তত্ত্ব-সংকুল কোনো সংঘাত সংঘর্ষ তাঁর উপন্যাসে নেই বলে, তিনি প্রকৃতই পাঁচালিকার, ঔপন্যাসিক নন। কিন্তু এ অভিমত কোনো দিক দিয়েই সমর্থনযোগ্য নয়। যাঁরা আধুনিক পাশ্চাত্য উপন্যাসের গতিপ্রকৃতির সন্ধান রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, একালে উপন্যাসের আকার আয়তন ও আঙ্গিকের অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে। সেদিক থেকে বিভূতিভূষণের উপন্যাস অভিনব ও মৌলিক।
COMMENTS